নিজস্ব প্রতিনিধি ১ ফেব্রুয়ারী,২০২০
উৎপল দত্ত
উৎপল দত্ত হলেন বাংলা নাটক থিয়েটার ও চলচ্চিত্র জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি একাধারে অভিনেতা পরিচালক, লেখক ও নাট্যকার। বাংলার গননাট্য আন্দোলনের তিনিই ছিলেন পুরোধা। প্রথমদিকে তিনি বাংলা থিয়েটারে অভিনয় করতেন, পরবর্তীকালে আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের তিনিই হয়ে ঊঠেছিলেন এক অগ্রনী ব্যাক্তিত্ব। তিনি হয়ে ওঠেন মঞ্চের কারীগর। গ্রুপ থিয়েটারের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যাক্তিদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।
ছোটবেলা
১৯২৯ সালের ২৯ শে মার্চ অবিভক্ত বাংলার বরিশালে জন্মগ্রহন করেন উৎপল দত্ত। তাঁর পিতা ছিলেন গিরীজারঞ্জন দত্ত। তিনি প্রাথমিকভাবে শিলং এর সেন্ট এডমুন্ড স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং পরবর্তীকালে তিনি কলকাতায় এসে তাঁর লেখাপড়া করতে থকেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুল থেকে। ১৯৪৫সালে তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষায় উত্তীর্ন হন। এরপর ১৯৪৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে ইংরাজীতে সাম্মানিক স্নাতক হন।
পারিবারিক জীবন
১৯৬০ সালে উৎপল দত্ত অপর এক থিয়েটার অভিনেত্রী শোভা সেনকে বিবাহ করেন। তাঁদের একমাত্র কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়া দত্ত, বর্তমানে দিল্লিতে অবস্থিত জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের 'Theater and Perfomance Studies' at the 'School of Arts & Asthetics' এর অধ্যাপিকা।
চলচ্চিত্র জীবন
উৎপল দত্ত নিজের কেরিয়ারের প্রথমার্ধে বাংলা থিয়েটারে অভিনয় করলেও বেশ কিছু ইংরাজী থিয়েটারেও তিনি অভিনয় করেছেন। কৈশোর জীবনেই ১৯৪০ সালে উৎপল দত্ত ইংরাজী থিয়েটারের প্রতি বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সেখানে কাজ করতে করতেই তিনি একসময় প্রতিষ্ঠা করেন 'দ্য শেক্সপিয়ারিয়ান্স' নামের এক থিয়েটার গ্রুপ। এই থিয়েটার গ্রুপের প্রথম কাজ ছিল রিচার্ড তৃতীয়। সেখানে উৎপল দত্ত রাজার ভুমিকায় অভিনয় করেন। সেখা তাঁর অভিনয়ে গুনমুগ্ধ হন এঈ থিয়েটার গ্রুপের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ। তাঁরা কালবিলম্ব না করে উৎপল দত্তকে ভাড়া করেন এবং এই থিয়েটার দলটি দেশ বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের অভিনয় মঞ্চস্থ করতে থাকে। পরবর্তীকালে উৎপল দত্ত স্বপ্রচেষ্টায় আইবিসেন, শ, টেগোর, গোর্কি অ্যান্ড কন্সট্যান্টাইন সিমোনভ প্রভৃতির মত বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য নাটকে অভিনয় ও প্রযোজনা করেছেন। এই থিয়েটার দলটির পরবর্তীকালে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় 'লিটল থিয়েটার গ্রুপ'। এই দলটি পরবর্তীকালে মনস্থ করে, তারা ইংরাজি নাটকের পাশাপাশি বেশ কিছু বাংলা নাটক মঞ্চস্থ করবে। উৎপল দত্ত গননাট্য আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তিনি এক সময় কলকাতার সাউথ পয়েন্ট স্কুলের ইংরাজীর অধ্যাপক ছিলেন। তিনি শেক্সপিয়ার ও রাশিয়ার বেশ কিছু ধ্রুপদি নাটক বাংলায় অনুবাদ করেন ও তা পরিচালনাও করেন। তিনি 'আর্য অপেরা' ও ' বিবেক যাত্রা সমাজ' নামে বেশ কিছু নাট্যদলও তৈরী করেন। উৎপল দত্ত বেশ কিছু হিন্দি সিনেমায় অভিনয় করেন। সেগুলির মধ্যে গুড্ডি, গোলমাল, নরম গরম, রঙ বিরঙ্গি এবং শৌকিন বিশেষ উল্লেখ্য। গোলমাল,রং বিরঙ্গি এবং নরম গরম সিনেমায় শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা হিসেবে ফিল্ম ফেয়ার সম্মানে ভূষিত হন। ভিবন সোম সিনেমায় অভিনয় করে, উৎপল দত্ত ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডের সম্মানে সম্মানিত হন। তাঁর অভিনীত সিনেমাগুলির মধ্যে আগন্তুক, জন অরন্য, জয় বাবা ফেলুনাথ, হিরক রাজার দেশে, পদ্মা নদীর মাঝি, বম্বে টকিজ, দ্য গুরু, শেক্সপিয়ার ওয়াল্লাহ, গুড্ডী, গোলমাল, কোতোয়াল সাহেব, শৌকীন, প্রিয়তমা,অমানুষ, আনন্দ আশ্রম, বরষাত কি এক রাত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বেশ কিছু হিন্দি সিনেমায় উৎপল দত্ত খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় অবতীর্ন হয়েছিলেন। সেখানেও তিনি চোখ ধাঁধানো অভিনয় করেছেন। সাত হিন্দুস্তানী সিনেমায় তিনি অমিতাভ বচ্চনের সাথে জুটি বেঁধে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনি একই সাথে থিয়েটার, বাংলা সিনেমা ও হিন্দি সিনেমায় দাপটের সাথে কাজ করে গিয়েছেন। বিংশ শতকের তিনিই ছিলেন অন্যতম বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব।
রাজনৈতিক জীবন
উৎপল দত্ত রাজনীতিগতভাবে মার্ক্সবাদী চিন্তা ভাবনার দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট মার্ক্সবাদী পার্টীর একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তাঁর বামপন্থী চিন্তাধারার বিকাশ ঘটত থিয়েটারের মঞ্চে। সমসাময়িক সামাজিক ঘটনাবলি নিয়ে তিনি বিভিন্ন নাটক মঞ্চস্হ করতেন। কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থনে বিভিন্ন পথনাটিকাকে তিনি মঞ্চস্থ করেছিলেন। ১৯৬৫ সালে কংগ্রেস সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তাঁকে বেশ কিছু মাস কারাবাস ভোগ করতে হয়। সেই সময়েই চারপাশে সরকারের বিরুদ্ধে শ্লোগান শোনা যাচ্ছিল। ১৯৬৮ সালে মিনার্ভা থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়েছিল মানুষের অধিকার। তাঁর কাজ তাকে সাধারন মানুষের অনেক কাছে এনে দিয়েছিল। তাঁর নাটকগুলিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। পূর্নাঙ্গ নাটক, পথ নাটিকা, যাত্রাপালা। উৎপল দত্তের বিখ্যাত নাটকগুলির মধ্যে রয়েছে টিনের তলোয়ার, মানুষের অধিকার ইত্যাদি।
অভিনীত চলচ্চিত্রসমূহ
উৎপল দত্ত অভিনীত সিনেমাগুলি হল,বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধূসুদন, বিক্রম ঊর্বশী, রানী রাসমনী, শুভলগ্ন, হারানো সুর, সপ্তপদী, রক্ত পলাশ, সূর্্যশিখা, শেষ অঙ্ক, মোমের আলো, শেক্সপিয়ার ওয়াল্লাহ, চৌরঙ্গী, সাত হিন্দুস্তানী, ভুবন সোম, দ্য গুরু, কলঙ্কিত নায়ক, বম্বে টকিজ, খুঁজে বেড়াই, গুড্ডী, ক্যালকাটা, সবশে বড়া সুখ, মেরে জীবন সাথী, এক আধুরী কাহানি, শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, মর্জিনা আবদুল্লাহ, হানিমুন, ঠগিনী, যুক্তি তক্কো আর গপ্পো, মি. রোমিয়ো, কোরাস, অসতী, পালঙ্ক, আনাড়ী, জুলি, অমানুষ, সেই চোখ, সন্তান, দো আনজানে, দত্তা, জন অরন্য, স্বামী, প্রিয়তমা, কিসসা কুরসি কা, ফরিস্তা ইয়া কাতিল, দুলহন ওহি যো পিয়া মন ভায়ে, অনুরোধ, আনন্দ আশ্রম, ইমান ধরম, ইয়েহি হ্যায় জিন্দেগি, কোত্যাল সাহেব, টুটে খিলোনে, জয় বাবা ফেলুনাথ, ধনরাজ তামাং, সফেদ হাতি, অতিথি, প্রেম বিবাহ, জোর, দ্যগ্রেট গ্যাম্বলার, গোলমাল, কর্তব্য, রাম বলরাম, আপনে পরায়ে, পাকা দেখা, হীরক রাজার দেশে, এগ্রিমেন্ট, বৈশাখী মেঘ, শৌকিন, সুবর্ন গোলক, মেঘমুক্তি, চালচিত্র, বরষাত কি এক রাত, নরম গরম, অগ্নিপরীক্ষা, আঙ্গুর, হামারী বহু অলকা, রাস্তে পেয়ার কে, রাজবধূ, শুভ কামনা, পসন্দ আপনি আপনি, কিসি স না কাহেনা, দুটি পাতা, রঙ বিরঙ্গি, আচ্ছা বুরা, ইয়ে দেশ, ইনকিলাব, লাখো কি বাত, জন জনি জনার্দন, লাভ ম্যারেজ, উলটা সিধা, অন্যায় অবিচার, আরপার, মেরা দামাদ, হরিশ্চন্দ্র শৈব্যা, সাহেব, কিসসা কাঠমান্ডু কা, সদা সুহাগন, পথভোলা, ম্যায় বলবান, কিরায়দার, বাত বন যায়ে, আপকে সাথ, আজ কা রবিন হুড, বাত বন যায়ে, আপ কে সাথ, আজ কা রবিন হুড, পেয়ার কে কাবিল, লা নিউট বেঙ্গলি, মহাবীর, বহুরানী, মেরা পতি সির্ফ মেরা হ্যায়, জওয়ানি জিন্দাবাদ, পথ ও প্রসাদ, জান পহেচান,আগন্তুক, পদ্মা নদীর মাঝি, অজানা পথ।
নাটক সমূহ
উৎপল দত্ত রচিত নাটকগুলি হল, মীরকাশিম, টিনের তলোয়ার, ফেরারী ফৌজ, বনিকের রাজদন্ড, ব্যারিকেড,ছায়ানট, কঙ্গোর কারাগারে, কল্লোল, অঙ্গার, আজকের শাহজাহান, লোহার ভীম, মানুষের অধিকার, এবার রাজার পালা, দাঁড়াও পথিকবর।
পুরষ্কার সমূহ
উৎপল দত্ত ১৯৯০ সালে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমী ফেলোশিপ পান থিয়েটার জগতে তাঁর অসামান্য অব্দানের জন্য
১৯৭০ সালে ভুবন সোম সিনেমায় ভুবন সোম চরিত্রের জন্য তিনি ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট অ্যাক্টর এর সম্মান পান।
কৌতুক চরিত্রে সেরা অভিনেতা হিসেবে তিনি ১৯৮০ ১৯৮২ এবং ১৯৮৭ সালে ফিল্ম ফেয়ার ফর বেস্ট কমেডিয়ান বিভাগে বিজয়ী হন।
১৯৯৩ সালে আগন্তুক সিনেমায় অভিনয়ের জন্য বেঙ্গলি ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাশোসিয়েশান অ্যাওয়ার্ডে তাঁকে সম্মানিত করা হয়।
১৯৭৫ ১৯৮০ এবং ১৯৮৬ সালে যথাক্রমে অমানুষ, গোলমাল ও সাহেব সিনেমায় সেরা সহ অভিনেতা হিসেবে উৎপলদত্তের নাম মনোনীত হয়।
মৃত্যু
১৯ সে আগষ্ট ১৯৯৩ সালে উৎপল দত্ত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন।
এই নিবন্ধটি পড়ার জন্যে ধন্যবাদ। অনুগ্রহ করে এই পেজ এবং ওয়েবসাইট সম্পর্কে আপনার বন্ধুদেরকে জানান। নিজের ফেসবুক বা টুইটারে শেয়ার করুন।ধন্যবাদ।